ইবলীস শয়তানের সৃষ্টি রহস্য
the devil all the time
ইবলীস শয়তানের সৃষ্টি রহস্য।
পূর্বেই বলা হয়েছে, শয়তানের সৃষ্টির কথা? তারপরও পাঠকের মনতৃপ্তির জন্য শয়তানের সৃষ্টি রহস্যের বিষয়ে বিস্তারিত আরও কিছু বলা প্রয়োজন মনে করছি।
ফেরেশতারা হল আল্লাহর নূর দ্বারা সৃষ্ট। তাঁদের আহার-বিহার, রোগ-শোক, কাম-ক্রোধ বলতে কিছুই নেই। তাঁরা নিষ্পাপ।
the devil tarot
সর্বদা আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত। তাঁদের পাখা আছে। সেই পাখা দিয়ে তাঁরা দুনিয়ার সর্বত্র পরিভ্রমণ করে বেড়ান। পাপ কর্ম কাকে বলে, তা তাঁরা অবগত নন। ভাল কর্ম ছাড়া মন্দ কর্ম তাদের ব্যাপারে কল্পনাই করা যায় না। ফেরেশতারা মানব চক্ষে অদৃশ্য । আগেই বলা হয়েছে, জ্বিন জাতি অগ্নি হতে সৃষ্টি আর মানব জাতির সৃষ্টি মাটি হতে। মানব জাতি আর জ্বিন জাতির মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। মানুষ যেমন পানাহার করে, বিবাহ-শাদী করে, তাদের জন্ম-মৃত্যু আছে, অনুরূপ জ্বিন জাতিরও আছে। তবে জ্বিন জাতি মানব চক্ষে অদৃশ্য আর মানব জাতি দৃশ্য । এছাড়াও, মানব জাতি আল্লাহর ইবাদতে অধিক অনুরক্ত। কিন্তু জ্বিন জাতি সেরূপ নয়; বরং তারা পুণ্যের কাজ হতে গুণাহের কাজে বেশি অনুরক্ত। মানব জাতি আশরাফুল মাখলুকাত তথা 'সৃষ্টির সেরা', কিন্তু জ্বিন জাতি তা নয়। ইবলীস শয়তানও এ জ্বিন জাতিরই অন্তর্ভুক্ত। কাজেই ইবলীস শয়তানও পাপ কার্যে সর্বাধিক অনুরাগী। ভাল কাজ সে জানেই না।
এই ইবলীস ছিল এক সময়ে ফেরেশতাদের প্রধান এবং তাঁদের ওস্তাদ। হযরত আদম (আঃ)কে সেজদা করার নির্দেশ অমান্য করায় সে হয়ে গেল বিতাড়িত শয়তান। ফেরেশতাদের সঙ্গ হতে তাকে বহিষ্কার করে দেয়া হল। জান্নাতে তার আর স্থান রইল না, সে পদে পদে লাঞ্ছিত, বিতাড়িত। আত্মগরিমা বা অহংকার শয়তানকে লাঞ্ছনার এমনিতর নিম্নস্তরে পৌঁছে দিল। শয়তানের দুঃখ ও ক্ষোভের সীমা রইল না। কিন্তু শয়তানের তখন আর করার কিছু রইল না।
the devil inside
অহংকার ও আত্মগরিমা এমনই ভয়ংকর চরিত্র যে, যার মধ্যে এ ধ্বংসাত্মক কুৎসিত স্বভাব থাকবে, তার দ্বীন-দুনিয়ার উন্নতি বলতে কিছুই অর্জিত হবে না। অহংকার একদিকে যেমন আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ ও খোদাদ্রোহী স্বভাব, অপরদিকে অহংকারী মানুষ মানব সমাজেও ধিকৃত। পরিণাম হয় তার অতীত, জাহান্নাম হয় তার জন্য অবধারিত।
যা হোক, শয়তান আর কোন উপায় না দেখে সে হযরত আদম (আঃ) এর শত্রু হয়ে গেল। যে আদম (আঃ) কে উপলক্ষ করে সে আজ শয়তান, জান্নাতে তার নেই স্থান; তাঁর বিরুদ্ধে যাওয়া বা শত্রু হওয়া স্বাভাবিক। শয়তান ভাবল, 'যে আদম (আঃ) এর জন্য আমি শয়তান হলাম, জান্নাত হতে বহিষ্কৃত হলাম, সেই আদম কিভাবে জান্নাতে বসবাস করে তা দেখে নিতে হবে –আমিও থাকব না, আর তাকেও থাকতে দেব না।
শয়তান উপায় খুঁজতে লাগল কিভাবে আদমকে জান্নাত থেকে বের করে আনা যায়। শুধু তাই নয়, যুগ যুগ ধরে আদম সন্তানকে কিরূপে বিপথগামী এবং আল্লাহর নির্দেশ বিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত করে তার মত অন্যায়কারী রূপে প্রতিষ্ঠিত করা যায় সে দুশ্চিন্তায় সে বিভোর। এজন্য বেশ সময়ের দরকার। এত স্বল্প সময়ে এত বড় কার্য সম্পাদন করা যে সহজ কথা নয় এবং ছেলে খেলাও নয় এ কথা শয়তান যথার্থই উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তাই আল্লাহ্র দরবারে সে তার কেয়ামত পর্যন্ত জীবন ভিক্ষা চেয়ে বলল :
رب فانظرني إلى يوم يبعثون ـ قال فانك من المنتظرين .
‘হে রব! আমায় কেয়ামত পর্যন্ত অবকাশ দিন।' (উত্তরে আল্লাহ তা'আলা) বললেন, 'আচ্ছা, তোমাকে অবশ্য অবকাশ দেয়া গেল।' -ছোয়াদ : ৭৯-৮০ একদিকে শয়তানের মনে আদম (আঃ)এর উপর ক্রোধ, তার উপর পেলা কেয়ামত পর্যন্ত আয়ুর নিশ্চয়তা। কাজেই এত বড় দীর্ঘ সময়ের সুযোগ সে হেলায় হারাতে রাজী নয়, যথাযথভাবেই ব্যবহার করবে সে এই অমূল্য সুযোগ;
the devil wears prada cast
একথা আল্লাহকে জানিয়ে শয়তান পুনরায় বলল :
'হে রব! অনন্তর আমি আক্রমণ চালাব আদমের উপর, তার সন্তানদের উপর, তাদের সম্মুখ ও পেছনের দিক দিয়ে। শুধু তাই নয়, তাদের ডান বাম দিয়েও আমার এ আক্রমণ অভিযান অনবরত চলতে থাকবে। একদিন দেখতে পাবেন, অধিকাংশ আদম সন্তান আপনার অকৃতজ্ঞ।' আদম সন্তানের উপর শয়তানের এরূপ অভিযান চালানোর কথাই বটে। কারণ, যার কারণে সে আজ অভিশপ্ত, এমনকি জান্নাত হতে সে বিতাড়িত, লাঞ্ছিত।
হাদীস শরীফে আছে, শয়তান মানুষের শিরা-উপশিরায় এবং প্রত্যেক স্থানে তার অভিযান চালাতে সক্ষম। এমনকি মানুষের অন্তরেও তার স্থান। এসব শয়তানী অভিযানের ফল আমরা প্রত্যক্ষ দেখতে পাই। আমরা যে অন্যায় কাজ করে থাকি, তার প্রেরণা আমাদের অন্তরে কে যোগায়। কে এর ওস্তাদ? সবই সেই ইবলীস শয়তানের প্রেরণ ও উপদেশক্রমে সংঘটিত হয়ে থাকে। আমরা অবুঝ শিশুর মত নীরবে তা সম্পাদন করে যাই। ঘুর্ণাক্ষরেও আমরা বুঝে উঠতে পারি না যে, এটা আমাদের চির শত্রু শয়তানের কর্মকাণ্ড।
আল্লাহ্ তা'আলা আদম সন্তানকে শয়তানের অভিযান হতে সাবধান থাকার জন্য নির্দেশ করলেন। এতে যে অবহেলা করবে তার এবং শয়তানেরই-বা পরকালে কি অবস্থা হবে, তা উচ্চারণ করে আল্লাহ তা'আলা শয়তানকে শুনিয়ে দিলেন—
لامـلـئـن جهنم منك ومن تبعك منهم أجمعين. ‘হে শয়তান! মনে রাখবে, আমি অবশ্যই জাহান্নাম পরিপূর্ণ করব তোমার এবং তোমার অনুগামীদের দ্বারা।' –সূরা ছোয়াদ : ৮-৫
“শয়তান তো শয়তানই। আল্লাহর এ হুশিয়ার বাণী সে শুনবে কেন? আরও পেয়েছে সে চিরদিনের জীবন — মরবে না সে কেয়ামত পর্যন্ত ।
শয়তানের সর্বপ্রথম অভিযান হল, কিরূপে আদমকে জান্নাত থেকে বের করা যায় । মনে পড়ল তার আল্লাহর সেই নিষেধ বাণী— یادم اسـكـن انـت و زوجك الجنة وكلامنها رغد احيت شما ولا
تقربا هذه الشجرة فتكونا من الظلمين.
অর্থাৎ 'হে আদম! জান্নাতে বসবাস কর, যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাও, যা ইচ্ছা তাই ভক্ষণ কর। কিন্তু ঐ বৃক্ষের কাছেও যেও না; গেলে তোমরা অন্যায়কারীদের দলভুক্ত হবে।
শয়তান উপায় খুঁজতে লাগল, কিরূপে আদমকে সে বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করানো যায় এবং অপরাধীরূপে জান্নাত হতে বের করে আনা যায়। অনেক চেষ্টার পরে একদা সে আদম (আঃ) ও তার সঙ্গিনী বিবি হাওয়াকে সেই বৃক্ষের ফল খাওয়ায়ে ফেলল । শয়তানের তো আর খুশীর সীমা থাকল না। তার প্রবঞ্চনা আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়ার উপর জয়লাভ করল। দুর্বৃত্ত শয়তান আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়াকে বিপদে নিক্ষেপ করে কেটে পড়ল।
আদম (আঃ) ও বিবি হাওয়া অপরাধীরূপে আল্লাহর দরবারে হাজির হল। আল্লাহ্ তা'আলা তাঁদেরকে এবং তাঁদের সন্তান-সন্ততিকে আরও পরীক্ষা করবেন। তাই তিনি তাঁদেরকে পরীক্ষার জন্য দুনিয়াতে প্রেরণের ইচ্ছা করলেন। আল্লাহ তা'আলা আদমকে লক্ষ্য করে বললেন :
قلنا لنا اهبطوا بعضكم لبعض عرج ولـكـم فـى الأرض
ستقر ومتاع.
the devil below
তোমরা সপরিবারে নীচে চলে যাও, দুনিয়ায় গিয়ে এখন বসবাস কর। মনে রাখবে, তোমরা একে অন্যের শত্রু থাকবে। কাজেই সাবধানতার সাথে সেখানে বসবাস করবে সেখানে তোমাদের জীবিকা রইল। ভূ-পৃষ্ঠেই তোমাদের স্থান-পরীক্ষা কেন্দ্র।
আল্লাহ্ তা'আলা আরো বলে দিলেন, 'দুনিয়াতেই তোমাদের জীবন-যাপন করতে হবে। আর সর্বশেষে কেয়ামতের পূর্বে আবার সেখান থেকেই পুনর্জীবন প্রাপ্ত হয়ে হাশরের ময়দানে উপস্থিত হতে হবে।'
অবশেষে আদম (আঃ) জান্নাত হতে পৃথিবীতে চলে এলেন। পৃথিবীতে এসে খুবই লজ্জা-শরমে কালযাপন করতে লাগলেন। এদিকে শয়তান তো তাঁর পেছনে লেগেই আছে, কোন সময় আদমকে বিপথগামী করা যায়। কিন্তু তা আর কি হয়! চক্রান্ত ও চালবাজী আর কতবার চলতে পারে! তবে এ কাজ করেই শয়তানের ক্রোধ মিটল না, যুগে যুগে আদম সন্তানকেও বিপথগামী করার উদ্দেশে লেগে আছে এবং থাকবে।