ইসলামের সামাজিক জীবন।

ইসলামী সামাজিক জীবনের মূলনীতি হলো দুনিয়ার সকল মানুষ সমান এবং সবাই একই পিতা-মাতা আদম ও হাওয়া (আ.)-এর সন্তান।



    ইসলামের সামাজিক জীবন।







    কোনো লোকই একা বেঁচে থাকতে পারে না। পিতা, মাতা, ভাই, বোন আত্মায় জন নিয়ে তার যে পরিবার, সেই পরিবার নিয়েও সে একা বাঁচতে পারে না। তাকে আরও অনেকের সাথে মিশতে হয়, লেনদেন ও মতের আদান প্রদান করতে হয়। মোটকথা, একটা সমাজের মধ্যে তাকে মিশে থাকতে হয়। পরিবার এবং সমাজের মধ্যে থেকে তার নিজের এবং সমাজের অন্যের উন্নতি, সুখ-শান্তির জন্য একজন মুসলমান আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর শেখানো। নীতিমালা অনুযায়ী চলে ।




    সকল মানুষ সমান।






    ইসলামী সামাজিক জীবনের মূলনীতি হলো দুনিয়ার সকল মানুষ সমান এবং সবাই একই পিতা-মাতা আদম ও হাওয়া (আ.)-এর সন্তান। দুনিয়ার মানুষের কারও গায়ের রং কালো, কারও সাদা, কারও বাদামি। একেকজনের ভাষা একেক রকম। সামাজিক রীতি-নীতি, চাল-চলন একেকজনের একেক রকম। তবুও সব মানুষ সমান। আমরা সকলে এক পিতা-মাতার সন্তান। এই মহৎ চিন্তা মানুষের মধ্যে প্রকৃত অনুভূতি সৃষ্টি করে। এই অনুভূতি মানুষকে অন্যের অধিকার সম্পর্কে সজাগ করে তোলে। মানুষে মানুষে স্বাভাবিক যে পার্থক্য তাকেও স্বীকার করে নেওয়া হয়। আমরা দুনিয়ার সকল মানুষ এক আল্লাহর সৃষ্টি এবং একই পিতা-মাতার সন্তান- এই সত্যকে যখন স্বীকার করে নেওয়া হয় তখন একজন অন্যজনের ভাষা, গায়ের রং, অন্যের সামাজিক রীতি নীতিকে মর্যাদা দিতে শিখে। তাই কুরআন এবং হাদিসে বারবার একথাই স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে—

    يأيها الناس اتقوا ربكم5 الذي خلقكم من نفس واحدة


    “হে মানুষেরা! তোমাদের রবকে ভয় কর যিনি তোমাদের একটি প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন।' সূরা আন নিসা : ১

    إنما المؤمنون10 إخوة

    "মুমিনরা তো পরস্পরের ভাই।' সূরা আল হুজরাত : ১০





    এভাবেই ইসলাম বর্ণগত, ভাষাগত, বংশগত, জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের দাবিকে নির্মূল করে প্রকৃত ভ্রাতৃত্বের পথকে সুগম করে তোলে ।






    অধিকার এবং মর্যাদার দিক থেকে সকল মানুষ সমান। এই নীতিমালার ওপর ইসলাম এক সুন্দর পরিবার, সুন্দর সমাজ, সুন্দর দেশ, সর্বোপরি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে চায়।





    পারিবারিক জীবন— ইসলামী সমাজের মূলভিত্তি



    প্রকৃতপক্ষে পারিবারিক জীবন ইসলামী সমাজের মূলভিত্তি। একটি সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য সমাজের প্রতিটি পরিবারকে সুন্দর করার পরিকল্পনা ইসলামে আছে। এজন্য পরিবারে স্বামীর ভূমিকা ও দায়িত্ব, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব, সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য- এসব বিষয়ে ইসলাম সুন্দর ও কার্যকর শাশ্বত বিধানসমূহ স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে। পারস্পরিক সহমর্মিতা, সহানুভূতি, সম্মানবোধ, শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ববোধ, এবং সর্বোপরি সমঝোতার জন্য কুরআন যেসব বিধান দিয়েছে এবং নবিজি যেসব উজ্জ্বল উদাহরণ তুলে ধরেছেন তার নজির ইতিহাসের বিরল ।






    একটি সুন্দর পরিবার গঠনের জন্য দেওয়া হয়েছে বিবাহের ব্যবস্থা। দেওয়া হয়েছে পর্দার বিধান। এক একটি সুন্দর পবিত্র বাগান হিসেবে ইসলাম সমাজের সকল পরিবারকে গড়ে তুলতে চায় ।




    নারীর মর্যাদা।





    সমাজে নারীর একটি বিশেষ মর্যাদা আছে। একটি সুন্দর পরিবার গঠনে মাতা, স্ত্রী হিসাবে নারীর ভূমিকা অনন্য। ইসলাম নারীর এই মর্যাদাকে স্বীকার করে নিয়েছে। নারীর মর্যাদা ইসলাম ছাড়া আর কোনো মতবাদ এত গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেনি। রাসূল (সা.) বলেছেন।




    “তুমি তোমার মায়ের পদযুগল জড়িয়ে থাকো (অর্থাৎ তার সেবা করো), কেননা তাঁর পায়ের নিকটেই জান্নাত রয়েছে। মিশকাত : ৪৯৩৯



    স্ত্রী হিসাবে নারীকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে নবি (সা.) বলেছেন।





    "তোমাদের মধ্যে সেই সবচেয়ে উত্তম যে তার পরিবারের কাছে উত্তম।' ইবনু মাজাহ, বিবাহ অধ্যায়




    কন্যা হিসাবে নারীর মর্যাদা ইসলাম সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে।



    অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারী পুরুষের মতো আয় করতে এবং সম্পদের মালিক হতে পারে। ইসলাম নারীকে উত্তরাধিকারের অধিকার দিয়েছে। পিতা, স্বামী অথবা তার পুত্রহীন ভাইয়ের সম্পত্তিতে তার অংশকে নির্দিষ্ট করেছে। ইসলামই নারীকে তার প্রতিভা বিকাশের সুযোগ এবং নির্ধারিত সীমার মধ্যে কাজ করার স্বাধীনতা দিয়েছে।




    আল্লাহ তাআলা বলেছেন।

    وما خلق الذكر والأنثى3 إن سعيكم لشتى

    'নারী-পুরুষ দুজনকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেকের রয়েছে নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য।' সূরা আল লাইল : ৩-৪




    প্রকৃতপক্ষে ইসলামই নারী ও পুরুষের মধ্যে সামাজিক কাজকে স্বাভাবিক ও প্রকৃতিগত ধর্ম অনুযায়ী ভাগ করে দিয়েছে। শরীরের দিক থেকে সবল ও মানসিক দিক থেকে সাহসী হওয়ার কারণে জীবনসংগ্রামে যুদ্ধ করার যোগ্যতা দিয়ে পুরুষকে বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর ভালোবাসা, মায়া, মমতা প্রভৃতি দুর্লভ গুণাবলির জন্য নারীকে দেওয়া হয়েছে সমাজের আগামী দিনের নাগরিকদের গড়ে তোলার কঠিন ও মহৎ দায়িত্বটি।




    এই প্রধান দায়িত্বের কথা উল্লেখ করার এই অর্থ নয় যে নারীদের অন্য কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।



    ইসলামের ইতিহাস এর সাক্ষ্য। সন্তান পালন ও সংসারের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বের সাথে সাথে মুসলিম নারীদের যুদ্ধক্ষেত্রে বিভিন্ন জিনিসপত্র বহন, আহত ও অসুস্থ রোগীদের সেবা, আহত রোগীদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া এমনকী কখনো প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করতেও দেখা গেছে। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম নারীকে তার সঠিক মর্যাদা দিয়েছে এবং প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মকে অস্বীকার করেনি।





    ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো মতবাদই নারীকে তার সঠিক মূল্য দিতে পারেনি। পাশ্চাত্যে নারী হচ্ছে আনন্দের সামগ্রী। 'নারী স্বাধীনতার' শ্লোগান দিয়ে পুরুষরা তাদের ধোকা দিচ্ছে। পাশ্চাত্য সমাজে নারীরা স্বাধীনতা পায়নি: পায়নি সমান অধিকার । মাঝখান থেকে সে হারিয়েছে পরিবারের এবং সমাজে তার স্বাভাবিক সহজাত মর্যাদা ও অধিকারকে।




    সামাজিক দায়িত্ববোধ।




    ইসলাম মানুষকে স্বার্থপরতা ত্যাগ করতে শিখায়। সমাজের প্রতি রয়েছে প্রতিটি ব্যক্তির দায়িত্ব। অন্যের জন্য চিন্তা-ভাবনা করা, অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসা, অন্যের জন্য অর্থ ব্যয়, এমনকী সমাজের কল্যাণের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেওয়ার প্রেরণা দেয় ইসলাম। অন্যদিকে ইসলাম ব্যক্তির কল্যাণে এগিয়ে আসার জন্য সমাজকে দায়িত্ব দিয়েছে। এ এক সুন্দর সম্পর্ক। যখন ব্যক্তি সক্ষম থাকে তখন সে হয় দানকারী এবং সমাজ হয় দান গ্রহণকারী। আর ব্যক্তি যখন অক্ষম হয়ে পড়ে তখন তাকে নিরাপত্তা ও সহায়তা দানের দায়িত্ব সমাজের। এভাবে ইসলামী সমাজে কোনো ব্যক্তি অন্যের ব্যাপারে উদাসীন হতে পারে না- হতে পারে না স্বার্থপর। সে এমন কোনো কাজও করতে পারে না যাতে সমাজের কোনো ক্ষতি হয়; বরং নিজের জন্য যা পছন্দ অন্যের জন্য তাই করতে বলা হয়েছে।



    ইসলামী সমাজের লক্ষ্য।





    সকল মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা এবং পারস্পরিক দায়িত্ববোধের ভিত্তিতে যে ইসলামী সমাজ গড়ে উঠে, সে সমাজে কোনো বিশেষ ব্যক্তির, বিশেষ বংশ ও গোত্রের, বিশেষ ভাষার মানুষের এবং কোনো বিশেষ জাতি বা বর্ণের বড়ো হওয়ার কোনো উপায় নেই। ওই সমাজের প্রধান লক্ষ্য হলো।




    আল্লাহর বন্দেগি এবং খোদার উদ্দেশ্য সফল করে তোলা। ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মমত্ব, ভ্রাতৃত্ব, পারস্পরিক সম্মানবোধ, সত্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা । ইসলামী সমাজ জীবনের উল্লেখযোগ্য মূল উপাদানগুলো হলো : সহযোগী লোকদের প্রতি ভালোবাসা, ছোটোদের প্রতি স্নেহ, বড়োদের শ্রদ্ধা, প্রতিবেশীদের অধিকার সচেতনতা, আর্তের সান্ত্বনা ও সমবেদনা, রোগীর সেবা, জীবন, সম্পত্তি ও সম্মানের প্রশ্নে অন্যের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা। কুরআনের অনেক আয়াত ও রাসূল (সা.)-এর অনেক বাণীতে প্রতিটি মুসলমানকে এসব গুণাবলি অর্জনের জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে।



    LikeYourComment