ইসলামে নারী পুরুষ সমান অধিকার।
নারী পুরুষ সমান অধিকার সংবিধান।
কুরআনুল করীম মানবগোষ্ঠীকে জন্মগতভাবে সমান মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে।
يأيها الناس انا خلقتكم من ذكر وأنثى وجعلتكم شعوبا وقبائل لتعارفوا ـ ان أكرمكم عند الله اتقكم ـ (الحجرات - ۱۳)
“হে মানবজাতি! আমরা তোমাদের সকলকে এক পুরুষ ও এক নারী হতে সৃষ্টি করেছি। পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন গোত্র ও বংশে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। আর তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে অধিক মুত্তাকী” (হুজুরাত : ১৩)।
এই কথাটিই নিম্নোক্ত বাক্যে বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে মহানবী (স) এর মুখে উচ্চারিত হয়েছিলঃ “কোন অনারবের উপর কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, আর না আছে কোন আরবের উপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব, কোন কালোর উপর কোন সাদার শ্রেষ্ঠত্ব নেই, আর না আছে সাদার উপর কোন কালোর শ্রেষ্ঠত্ব - তাকওয়া ছাড়া।” অর্থাৎ শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া।
"তোমরা সবাই আদমের সন্তান (বংশধর), আর আদম (আ) মাটির তৈরি” (বুখারী, মুসলিম)।
কুরআন মজীদ ও রসূলে করীমের এই বাণীসমূহের আলোকে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানায় বসবাসকারী সকল মানুষ আইনের চোখে সমান মর্যাদার অধিকারী। সামাজিক জীবনেও তাদের মধ্যে তাকওয়া (আল্লাহভীতি) ব্যতিরেকে শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণের কোন মানদন্ড নেই। রক্ত সম্পর্কের ভিত্তিতে ইসলাম সমগ্র মানব জাতিকে এক সমতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। আর ঈমান ও ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে মুসলমানদেরকে পরস্পর ভাই ভাই হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেছে। ইরশাদ হচ্ছেঃ نما المؤمنون اخوة - (الحجرات - ۱۰)
"নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই” (হুজুরাত ১০)।
রসূলুল্লাহ (স) শুধুমাত্র মুসলমানদেরকেই নয়, দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে একে অন্যের ভাই বলে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেনঃ“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, সকল মানুষ পরস্পর ভাই ভাই”- (আবু দাউদ, নামায অধ্যায়)।।
নবী যুগ, খোলাফায়ে রাশেদীনের আমল এবং পরবর্তী কালে আমরা এমন অনেক উদাহরণ পাই, যেখানে মনিব-গোলাম, শাসক-শাসিত, আমীর-ফকীর, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রে ইনসাফের বেলায় কঠোরভাবে সাম্যনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। অধিকার ও পারস্পরিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে রসূলে করীম (স) হর হামেশা নিজেকে অপরের সমতুল্য মনে করতেন। অভিজাত কুরায়শ বংশের ফাতিমা নাম্নী এক নারী চুরি করে ধরা পড়ল। হযরত উসামা (রা) তাকে মাফ করে দেওয়ার সুপারিশ করলে মহানবী (স) কঠোর ভাষায় বলেন ঃ
“হে উসামা। আল্লাহ্র নির্ধারিত শাস্তির ব্যাপারে সুপারিশ করে অনধিকার চর্চা করছ? সাবধান! আর কখনও এরূপ ভুল করবে না।” অতঃপর তিনি হযরত বিলাল (রা)-কে নির্দেশ দিলেন মসজিদে মুসলমানদের একত্র করতে। মুসলমানরা সমবেত হলে তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেন : 'তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহ এজন্যই ধ্বংস হয়েছে যে, তারা সাধারণ লোকদের ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী শাস্তি কার্যকর করত, কিন্তু বিশিষ্ট লোকদের কোন শাস্তি দিত না। সেই মহান সত্তার শপথ যাঁর মুঠোয় আমার জীবন! যদি মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমাও এরূপ করত তবে আমি তারও হাত কাটতাম” (বুখারী, মুসলিম)।
মুসলমানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে :
بأيها الذين أمنوا كونوا قومين الله شهداء بالقسط ولا يجرمنكم . شتان قوم على الا تعدلوا ـ اعدلوا هو أقرب للتقوى واتقوا الله إنّ
-
"হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে; কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেন কখনো সুবিচার বর্জনে
প্ররোচিত না করে। তোমরা ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করবে। এটা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জ্ঞাত" (মাইদা ঃ ৮)।
যদিও নবী করীম (স) কখনো কারো প্রতি অন্যায় আচরণ করেননি কিন্তু তা সত্ত্বেও আল্লাহ্র এই নির্দেশ ইসলামী সমাজে কার্যত বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে তিনি এত অধিক সতর্ক ও যত্নবান ছিলেন যে, তিনি বারংবার লোকদের বলতেন, কারো সাথে অন্যায় আচরণ করা হয়ে থাকলে সে যেন আমার নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করে। তাঁর পবিত্র জীবনে এমন কতক ঘটনার সন্ধান মিলে যাতে তিনি নিজেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পেশ করেছিলেন। হযরত সাওয়াদ ইবনে উমার (রা) বলেন, একবার আমি রঙ্গীন পোশাক পরিধান করে মহানবী (স)-এর খেদমতে হাযির হলাম। তিনি আমাকে দূর হও, দূর হও বলে ছড়ি দ্বারা টোকা দিলেন। আমি আরজ করলাম : "হে আল্লাহ্র রসূল। আমি এর প্রতিশোধ গ্রহণ করব। তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর পেট মুবারক আমার সামনে খুলে দিলেন” (রহমাতুললিল আলামীন, ১ম খন্ড, পৃ. ২৬৫) ।
এমনিভাবে বদরের যুদ্ধক্ষেত্রে হযরত সাওয়াদ ইবনে গাযিয়া (রা)-কে, এক মজলিসে কথা প্রসঙ্গে হযরত উসায়দ ইবনে হুদায়র (রা)-কে এবং গনীমতের মাল বন্টনকালে জনৈক সাহাবীকে ছড়ির অগ্রভাগ দিয়ে আঘাত করার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি নিজকে তাদের সামনে পেশ করেন” (মুহাম্মাদ হাফীযুল্লাহ, ইসলামী মাসাওয়াত, করাচী ১৯৭১ খৃ. পূ. ৮৫)।
রসূলে করীম (স)-এর প্রতিষ্ঠিত এসব উপমার বরাত দিয়ে হযরত উমার (রা) মিসরের গভর্নর হযরত আমর ইবনুল আস (রা)-র এক অভিযোগের জবাব দিয়েছিলেন। অভিযোগটি এই ঃ “হে আমীরুল মুমিনীন! মনে করুন, এক ব্যক্তি কোন এক অঞ্চলের শাসক এবং তিনি একজনকে শাস্তি দিচ্ছেন তাহলে আপনিও তার থেকে প্রতিশোধ নেবেন?”
জবাবে তিনি বলেছিলেন : “সেই মহান সত্তার শপথ যাঁর নিয়ন্ত্রণে আমার জীবন! আমি তার থেকেও মযলুমের পক্ষে প্রতিশোধ নেব। কেননা আমি রসূলে করীম (স)-কে দেখেছি যে, তিনি নিজকে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য মানুষের সামনে পেশ করতেন” (ইসলাহী, ইসলামী রিয়াসাত, পৃ. ৪২, কিতাবুল খারাজের বরাতে)।
সুতরাং তিনি তাঁর দশ বছরের খেলাফতকালে এই সাম্যনীতির বাস্তবায়নে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। জাবালা ইবনে আয়হাম গাসসানী যখন এক বেদুঈনকে চপেটাঘাত করার কিসাস থেকে বাঁচার জন্য এই দলীল পেশ করেছিল যে, হে আমীরুল মুমিনীন! তা কিভাবে হতে পারে? সে তো নগণ্য এক ব্যক্তি, আর আমি হলাম বাদশাহ?” তখন উমার (রা) বলেন, “ইসলাম তো আপনাদের দুইজনকে ভাই ভাই করে দিয়েছে। আপনি শুধুমাত্র তাকওয়ার বিচারে তার উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারেন, অন্য কোন পন্থায় নয়” (উমার ইবনুল খাত্তাব, পৃ. ২৫৪)।
“তিনি (উমার) হযরত আবু মূসা আশআরী (রা), হযরত আমর ইবনুল আস (রা), তাঁর পুত্র মুহাম্মাদ, হিমসের গভর্নর আবদুল্লাহ ইবনে কুরত (রা) এবং বাহরাইনের গভর্নর কুদামা ইবনে মাযউন (রা)-র বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান এবং স্বয়ং আপন পুত্র আবদুর রহমানের উপর হদ্দের শরঈ শাস্তি কার্যকর করে আইনের চোখে সাম্যের এমন উপমা স্থাপন করলেন বিশ্বের ইতিহাসে যার নযীর বিরল” (এই ঘটনার জন্য দ্র. তানতাবীর উমার ইবনুল খাত্তাব এবং শিবলীর আল-ফারূক)।
হযরত যায়েদ ইবনে ছাবিত (রা) আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় বিবাদী হিসাবে তাঁর উপস্থিতি, তাঁকে সম্মান প্রদর্শনে অসন্তোষ প্রকাশ এবং একথা বলা যে, "এটা তোমার প্রথম অন্যায়”, মামলার বাদী হযরত উবাই ইবনে কাব (রা)-র সমপর্যায়ে বসা এবং সাক্ষ্য উপস্থিত না করে শপথের উপর সম্মতি প্রকাশ করা; অতঃপর যায়দ ইবনে ছাবিত (রা)- পরামর্শক্রমে উবাই ইবনে কাবের ক্ষমা করার প্রতি রাগান্বিত হওয়া এবং এই কথা বলা যে, যায়েদ! যতক্ষণ পর্যন্ত একজন সাধারণ নাগরিক ও উমার তোমাদের কাছে সমান মর্যাদা সম্পন্ন না হবে ততক্ষণ তুমি বিচারকের পদের যোগ্য বিবেচিত হতে পারবে না।”
এ হচ্ছে ইসলামে বিচার বিভাগীয় সাম্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই ধরনের অপর একটি উপমা কায়েম করেন হযরত আলী (রা) তাঁর খেলাফতকালে। লৌহবর্ম চুরির মামলায় ফরিয়াদী হিসাবে তিনি কাযী শুরায়হ্-এর আদালতে উপস্থিত হন। আসামী ছিল একজন যিম্মী। কাযী শুরায়হ্ হযরত আলী (রা)-কে সম্বোধন করে বলেন, “হে আবু তুরাব! আপনি প্রতিপক্ষের সামনাসামনি বসুন।” কাযী সাহেব বুঝতে পারলেন যে, এই কথাটি হযরত আলী (রা)-র কাছে খারাপ লেগেছে। তিনি বলেন, “ওহে আবু তুরাব! সম্ভবতঃ আমার কথা আপনার নিকট অপসন্দনীয় হয়েছে, অথচ ইসলামের আইন ও আদালত সম্পর্কীয় সামানীতির আবেদন হচ্ছে ফরিয়াদী ও আসামীর একই সমতলে বসা।”
হযরত আলী (রা) বললেন, আমার প্রতিপক্ষের সমান স্তরে আমাকে উপবেশন করার নির্দেশ আমার কাছে অপ্রিয় মনে হয়নি, বরং আমার কাছে যা অপ্রিয় মনে হয়েছে তা এই যে, আপনি আমাকে উপনামে সম্বোধন করেছেন। এভাবে আমার প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় আমাকে সম্মান প্রদর্শন করেছেন। এটা তো আমার প্রতিপক্ষের সাথে আপনি স্পষ্ট অন্যায় করলেন” (ইসলাহী, ইসলামী রিয়াসাত, পৃ. ৪৫)।
হযরত উমার (রা) পুরুষদেরকে নারীদের সাথে অবাধে ঘোরাফেরা করতে নিষেধ করেছিলেন। এক ব্যক্তিকে মহিলাদের সাথে নামায পড়তে দেখে তাকে চাবুক লাগালেন। সে বলল, "আল্লাহ্র শপথ! যদি আমি ভালো কাজ করে থাকি তাহলে আপনি আমার প্রতি জুলুম করলেন। আর যদি আমি মন্দ কাজ করে থাকি তাহলে আপনি এর আগে আমাকে তা জানাননি।” তিনি বললেন, “তুমি কি আমার নসীহত করার সময় উপস্থিত ছিলে না?” সে বলল, না।
তিনি তার সামনে চাবুকটি রেখে বললেন, "আমার কাছ থেকে প্রতিশোধ নাও।” সে বলল, “আজ নিচ্ছি না।” তিনি বললেন, “বেশ তাহলে ক্ষমা করে দাও।” সে বলল, “ক্ষমাও করছি না”। অতঃপর উভয়ই একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে গেলেন। পরদিন সাক্ষাত করে সে হযরত উমার (রা)-কে মলীন চেহারায় দেখতে পেল। সে বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! সম্ভবত আমার কথায় আপনি বিব্রত বোধ করছেন? তিনি বললেন, হাঁ। সে বলল, "আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি” (মাওয়ারদী, আহকামুস সুলতানিয়া, উর্দূ অনু, পৃ. ২২৫)।
কুরআনুল করীমে ফেরাউনের যে হীন অপকর্মের উল্লেখ আছে তার একটি ছিল এই যে, সে তার জাতিকে উঁচু-নীচু ও আশরাফ-আতরাফের বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে রেখেছিল। এদের মধ্যে এক শ্রেণীকে সে তার জুলুম নির্যাতন ও অত্যাচার-অবিচারের যাঁতাকলে বেঁধে রাখত এবং তাদের অপমানিত ও লাঞ্ছিত করত।
ان فرعون علا في الأرض وجعل أهلها شيعا يستضعف طائفة
“ফেরাউন দেশে (মিসরে) বিদ্রোহ করেছিল এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে তাদের একটি শ্রেণীকে সে হীনবল করে রেখেছিল” (কাসাস : ৪)।
এর বিপরীতে ইসলামের কৃতিত্ব এই যে, সে উঁচুকে নিচু এবং নিচুকে উঁচু করে সমাজে ভারসাম্য স্থাপন করেছে এবং মানুষের মাঝে সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে।
হযরত উমার (রা)-কে যখন মক্কার গভর্নর নাফে ইবনুল হারিস জানান, আমি মুক্তদাস ইবনুল বারাকে আমার স্থলাভিষিক্ত নিয়োগ করে এসেছি, তখন তিনি তার যোগ্যতা ও গুণাবলীর কথা শুনে অত্যন্ত খুশী হয়ে বলেন, “কেন হবে না, আমাদের নবী (স) বলে গেছেন যে, আল্লাহ তাঁর এই কিতাবের বদৌলতে কতককে উপরে উঠাবেন এবং কতককে নীচে নামিয়ে দেবেন (ইসলামী মাসাওয়াত, পৃ. ১০০)।